প্রবন্ধ
সহীহ জিকির ও গলত জিকির | পর্ব ৩
বিগত কয়েকটি প্রবন্ধের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, ইসলামে সিররী বা খফী জিকির যেমন বিধিবদ্ধ, তেমনি জেহেরী জিকিরও নিয়মসিদ্ধ এবং উভয় জিকিরের পক্ষে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে নির্ভরযোগ্য দলীল-প্রমাণ রয়েছে। তাই উভয় জিকিরই ইসলামসম্মত। তবে এখন প্রশ্ন জাগে, কোন্ জিকির উত্তম--সিররী জিকির নাকি জেহেরী জিকির। এ বিষয়ে এবার আলোচনা করা হচ্ছে।
সেররী জিকির ও জেহেরী জিকিরের মধ্যে কোনটি উত্তম
জেহেরী জিকির ও সিররী জিকিরের মধ্যে কোনটি উত্তম--এ নিয়ে মুহাক্কিক উলামায়ে কিরামের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন--জেহেরী জিকির উত্তম, আবার কেউ বলেন--সিররী জিকির উত্তম। সেই ভিত্তিতে তাদের মাঝে জিকিরের আমলে পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়।
যারা বলেন, সিররী জিকির উত্তম, তারা এ দলীল দেন যে, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে প্রথমত সিররী জিকিরের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন--
وَاذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ تَضَرُّعًا وَّخِیۡفَۃً وَّدُوۡنَ الۡجَہۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ
“এবং স্বীয় পালনকর্তার জিকির করুন চুপে চুপে বিনম্রভাবে ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এবং খুব জোরের চেয়ে কম আওয়াজে।”
(সূরাহ আ‘রাফ, আয়াত নং ২০৫)
তেমনিভাবে হাদীস শরীফের বর্ণনায় রয়েছে যে, সাহাবীগণ জোরে জিকির করতে থাকলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে সেভাবে জিকির করতে নিরুৎসাহিত করে আস্তে জিকির করতে বলেন। সেই হাদীসটি নিম্নরূপ--
عَنْ أَبِي مُوسَى رضي الله عنه قَالَ : كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ ، فَكُنَّا إِذَا عَلَوْنَا كَبَّرْنَا (وَفِيْ رِوَايَةِ مُسْلِمِ : فَجَعَلَ النَّاسُ يَجْهَرُونَ بِالتَّكْبِيرِ) ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَيُّهَا النَّاسُ ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ، فَإِنَّكُمْ لاَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا ، وَلَكِنْ تَدْعُونَ سَمِيعًا بَصِيرًا -
হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন--“আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। সে সময় যখন আমরা কোন উঁচু স্থানে উঠতাম, তাকবীর বলতাম। (সহীহ মুসলিমের রিওয়ায়াতে রয়েছে : সে সময় লোকেরা উচ্চস্বরে তাকবীর বলতে থাকেন।) তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন--“হে লোক সকল! তোমরা নিজেদের উপর নম্রতা করো। কেননা, তোমরা কোন বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছো না। বরং তোমরা ডাকছো সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টাকে।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৪৭/ অনুরূপ : সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫০০২)
তা ছাড়া জোরে জিকির করলে আশপাশের লোকদের ঘুম বা ইবাদতে বিঘ্নতা ঘটতে পারে। এতদ্ব্যতীত তাতে রিয়া বা লোক দেখানোর নিয়তের আশংকা থাকে--যার কারণে ছাওয়াবের পরিবর্তে শিরক গুনাহ হবে।
পক্ষান্তরে যারা জেহেরী জিকিরকে উত্তম বলেন, তাদের দলীল হলো--বিভিন্ন হাদীসে জোরে বা জেহেরীভাবে জিকির করার কথা বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, নামাযের পর রাসূলুল্লাহ (সা) উচ্চস্বরে তাকবীর-তাহলীল ও দু‘আ-জিকির পড়তেন বলে হাদীস শরীফে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে--
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : كُنْتُ أَعْرِفُ انْقِضَاءَ صَلاَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالتَّكْبِيرِ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন--“আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামায শেষ হওয়া বুঝতাম তাঁর (উচ্চস্বরে) তাকবীর শুনে।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮১৯)
তেমনি অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে--
عن عبدالله بن الزُّبَيْر رضي الله عنه قَالَ: كان رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول في دُبُر الصلاة إذا سَلَّم قبل أن يقومَ يرفع بذلك صوتَهُ: «لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملكُ، وله الحمدُ، وهو على كل شيء قديرٌ، ولا حول ولا قوة إلا بالله، لا إله إلا الله، لا نعبُد إلا إياه، له النعمةُ وله الفضلُ، وله الثناء الحسنُ، لا إله إلا الله مخلصين له الدين، ولو كره الكافرون
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাযের পর যখন সালাম ফেরাতেন, তখন দাঁড়ানোর পূর্বে উচ্চস্বরে বলতেন--
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَلاَ نَعْبُدُ إِلاَّ إِيَّاهُ لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
(মু‘জামে তাবরানী কাবীর, মুসনাদে আবদুল্লাহ অধ্যায়, ৬০ পৃষ্ঠা : হাদীস নং ৭২)
তেমনি ফরজ নামাযের পর উচ্চস্বরে জিকির করার বিশেষ আমল সাহাবীগণের মধ্যে বিদ্যমান ছিলো বলে হাদীসে রয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীস নিম্নরূপ--
عن ابْن عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا : أَنَّ رَفْعَ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ حِينَ يَنْصَرِفُ النَّاسُ مِنَ المَكْتُوبَةِ كَانَ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ كُنْتُ أَعْلَمُ إِذَا انْصَرَفُوا بِذَلِكَ إِذَا سَمِعْتُهُ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন--যখন মানুষেরা ফরজ নামায থেকে ফিরেন, তখন জিকিরে আওয়াজকে উচ্চ করা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যমানায় বিদ্যমান ছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “যে সময় মুসল্লীগণ সালাম ফিরাতেন, তখন আমি তাদের উচ্চস্বরে যিকিরের আওয়াজ যখন শুনতাম, তখন তা বুঝতে পারতাম ।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৪১)
তেমনি সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর মধ্যে আইয়্যামে তাশরীকের সময় পথে-ঘাটে ও হাট-বাজারে উচ্চস্বরে জিকির করার নিয়ম ছিলো। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে রয়েছে--
وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ وَأَبُو هُرَيْرَةَ يَخْرُجَانِ إِلَى السُّوقِ فِي أَيَّامِ الْعَشْرِ يُكَبِّرَانِ، وَيُكَبِّرُ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِمَا
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও হযরত আবু হুরাইরা (রা.) যিলহজ্বের দশকে বাজারে যেতেন তাকবীর বলতে বলতে এবং তাদের তাকবীর শুনে মানুষেরা তাকবীর বলতেন।” (হযরত আফফান (রহ.)-এর রিওয়ায়াতে রয়েছে : তাঁরা তখন তাকবীর বলে মানুষদেরকে তাদের সাথে তাকবীর বলানোর জন্যই বাজারে যেতেন।)
(দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, ৪৫৮ পৃষ্ঠা)
অনুুরূপভাবে সাহাবীগণ (রা.) ঘরে, মসজিদে ও বিভিন্ন স্থানে উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে রয়েছে--
وَكَانَ عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يُكَبِّرُ فِي قُبَّتِهِ بِمِنًى فَيَسْمَعُهُ أَهْلُ الْمَسْجِدِ فَيُكَبِّرُونَ وَيُكَبِّرُ أَهْلُ الْأَسْوَاقِ حَتَّى تَرْتَجَّ مِنًى تَكْبِيرًا
“হযরত উমর (রা.) মিনায় স্বীয় হুজরায় তাকবীর বলতেন। সেই তাকবীর মসজিদের মুসল্লীগণ শুনতেন, তখন তাঁরা তাকবীর বলতেন। এবং বাজারের লোকজন (তাদের তাকবীর শুনে) তাকবীর বলতেন। তা এ পর্যন্ত হতো যে, মিনা তাকবীর ধ্বনিতে কেঁপে উঠতো।”
(দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা)
তেমনিভাবে স্বাভাবিক পথ চলতে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, উঁচুস্থানে উঠতে “আল্লাহু আকবার” এবং কোন নিচুভূমিতে নামতে “সুবহানাল্লাহ” উচ্চস্বরে পাঠ করা সুন্নাত আমল হিসেবে গণ্য। এ সম্পর্কে সহীহ মুসলিম-এর শরাহ ‘ফাতহুল মুন‘ইম-এর মধ্যে রয়েছে--
كانت السنة رفع الصوت بالتكبير والتهليل كلما علا مرتفعا وكلما هبط واديا
“যতবার কোন উঁচু স্থানে উঠবে এবং যতবার কোন নিম্নভূমিতে নামবে, তখন উচ্চস্বরে তাকবীর ও তাহলীল পাঠ করা সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।
(দ্রষ্টব্য : ফাতহুল মুন‘ইম শরহু মুসলিম, ১০ খণ্ড, ২৫৯ পৃষ্ঠা)
অপরদিকে প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাব মুস্তাদরাকে হাকীম-এর মধ্যে জেহেরী জিকিরের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে فضيلة رفع الصوت بالذكر (উঁচু আওয়াজে জিকির করার ফজীলত) নামে আলাদা শিরোনাম দিয়ে বিশেষ পরিচ্ছেদ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) উচ্চস্বরে জিকিরকারী সাহাবী আবদুল্লাহ যুল বিজাদাইন (রা.)কে “নিবেদিত জিকিরকারী” বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং সেই সাহাবীর ওফাতের পর তাঁর করবে নেমে তাঁর লাশ স্বয়ং নিজ হাতে কবরে রেখে তাঁকে দাফন করেছেন। উক্ত হাদীসটি নিম্নরূপ--
عَنْ جَابِرٍ رضي الله عنه أَنَّ رَجُلًا كَانَ يَرْفَعُ صَوْتَهُ بِالذِّكْرِ، فَقَالَ رَجُلٌ: لَوْ أَنَّ هَذَا خَفَضَ مِنْ صَوْتِهِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَإِنَّهُ أَوَّاهٌ» . قَالَ: فَمَاتَ فَرَأَى رَجُلٌ نَارًا فِي قَبْرِهِ، فَأَتَاهُ فَإِذَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيهِ وَهُوَ يَقُولُ: «هَلُمُّوا إِلَى صَاحِبَكُمْ» . فَإِذَا هُوَ الرَّجُلُ الَّذِي كَانَ يَرْفَعُ صَوْتَهُ بِالذِّكْرِ
হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, জনৈক সাহাবী (রা.) (তাঁর নাম আবদুল্লাহ যুল বিজাদাইন আল-মুযানী) উচ্চস্বরে জিকির করতেন। তখন অন্য একজন বললেন, যদি এই লোক নীচু আওয়াজে জিকির করতেন (ভাল হতো)! তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে তো ‘আওয়্যাহ্’ (নিবেদিত জিকিরকারী)। হযরত জাবির (রা.) বলেন, এরপর সেই ব্যক্তি মারা গেলেন। তখন এক লোক তার কবরে আলোক দেখতে পেলেন। তা দেখে তিনি সেখানে গেলেন। অকস্মাৎ তিনি দেখেন, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) কবরের মধ্যে রয়েছেন এবং তিনি বলতেছেন, তোমাদের সাথীকে দাও। তখন দেখা গেলো যে, তিনি সেই ব্যক্তি যিনি উঁচু আওয়াজে জিকির করতেন। (তাঁর দাফনের জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) কবরে নেমেছেন!)
(মুস্তাদরাকে হাকিম, ১ম খণ্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ১৩৬১/ অনুরূপ : সুনানে বাইহাকী--শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৫৭৮ প্রভৃতি)
তেমনি অপর রিওয়ায়াতে সন্ধ্যার সময় লোকদের জেহেরী জিকিরকে হযরত উমর (রা.)-এর উৎসাহিত করা সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে--
عن عطية بن قيس قَالَ : كان الناس يذكرون الله عند غروب الشمس، يرفعون أصواتهم بالذكر، فإذا خفضت أصواتهم أرسل إليهم عمر بن الخطاب أن يرددوا الذكر.
“হযরত আতিয়্যা ইবনে কাইস (র.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে মহান আল্লাহর জিকির করতেন। যখন তাদের স্বর নিচু হয়ে গেলো, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খবর পাঠালেন--যেন তারা পুনরায় সেরূপ (উচ্চস্বরে) জিকির করেন।
(দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী, ৫ম খণ্ড, ২৩৭ পৃষ্ঠা/ কিতাবুয জিকর--জা‘ফর আল-ফারইয়াবী, হাদীস নং ৬৯)
এভাবে উভয় পক্ষই যার যার অবস্থান সম্পর্কে দলীল পেশ করেন এবং সেই ভিত্তিতে উত্তম মনে করে কেউ সিররী জিকির করেন, আবার কেউ জেহেরী জিকির করেন। তবে যেহেতু উভয়পক্ষেই দলীল রয়েছে, তাই কোনটাকে অবজ্ঞা করা যায় না।
বিশেষ করে উভয় প্রকার জিকিরের মধ্যেই বিশেষ ফায়েদা নিহিত রয়েছে। যেমন, সিররী জিকিরের ফায়দা সম্পর্কে আল্লামা ত্বাহত্বাবী (রহ.) মারাকিল ফালাহ-এর হাশিয়ায় বলেন--
اختُلِفَ؛ هل الإسرار بالذكر أفضل ؟ فقيل: نعم، لأحاديث كثيرة تدل عليه منها: "خير الذكر الخفي، وخير الرزق ما يكفي". ولأن الإسرار أبلغ في الإخلاص، وأقرب إلى الإجابة
“সিররী জিকির উত্তম কিনা--এতে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, হ্যাঁ, সিররী জিকির উত্তম। কেননা, এ ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যের একটি হাদীস হলো--‘উত্তম জিকির হচ্ছে খফী জিকির এবং উত্তম রিযিক হচ্ছে যা যথেষ্ট হয়।’ (তবে তাহকীকের মাধ্যমে জানা যায় যে, এ হাদীসটি জয়ীফ ও মুনকার।) এ ছাড়াও সিররী জিকির এ কারণে উত্তম যে, এটা ইখলাস অর্জনে অধিক কার্যকর এবং এটা কবূল হওয়ার অধিক নিকটবর্তী।”
(দ্রষ্টব্য : হাশিয়াতুত্ব ত্বাহত্বাবী ‘আলা মারাকিল ফালাহ, ২০৮ পৃষ্ঠা)
অপরপক্ষে জেহেরী জিকিরের উত্তমতা বর্ণনা করে তার ফায়দা সম্পর্কে সহীহ মুসলিম-এর শরাহকারী আল্লামা নাওয়াবী (রহ.) বলেন--
والجهر أفضل في غير ذلك ؛ لأن العمل فيه أكثر، ولأن فائدته تتعدى إلى السامعين، ولأنه يوقظُ القارىء، ويجمع همه إلى الفكر، ويصرف سمعه إليه، ويطرد النوم، ويزيد في النشاط
“যেসব ক্ষেত্রে রিয়ার ভয় নেই এবং মুসল্লী ও ঘুমন্ত ব্যক্তিদের কষ্টের আশংকা নেই, সেসব ক্ষেত্রে জেহেরী জিকির উত্তম। কেননা, সালফে সালিহীনের এরূপ আমল অধিক। তা ছাড়া জেহেরী জিকির শ্রবণকারীদের পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, এটা পাঠকারীকে জাগ্রত রাখে, এটা তার চিন্তা-চেতনাকে ফিকিরের দিকে একত্রিত করে, এটা তার কানকে তার দিকে নিবেশিত করে, ঘুমকে দূর করে দেয় এবং উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে।”
(আল-মাজমূ‘, ২য় খণ্ড, ১৯২ পৃষ্ঠা/ আত-তিবয়ান, ১০৪ পৃষ্ঠা)
এভাবে উভয় প্রকার জিকিরের ফায়েদার দ্বারা উভয়টারই উত্তমতা উদ্ভাসিত হয়। এমতাবস্থায় উভয় প্রকার জিকিরের দলীল ও ফায়েদার দিক বিবেচনায় নিয়ে এতদুভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করে ফাতাওয়া বাযযাযিয়া’য় বলা হয়েছে--
وجُمع بين الأحاديث الواردة بأن ذلك يختلف بحسب الأشخاص والأحوال ؛ فمن خاف الرياء، أو تأذَّى به أحد كان الإسرار أفضل، ومتى فُقد ما ذكر كان الجهر أفضل. قال في "الفتاوي": لا يُمنع من الجهر بالذكر في المساجد، احترازاً عن الدخول تحت قوله تعالى: {ومَنْ أظلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مساجدَ اللهِ أنْ يُذكَرَ فيها اسمُه} [البقرة: 114]
“এ ব্যাপারে বর্ণিত উভয় প্রকার হাদীসসমূহের মাঝে সমন্বয় করা হয় এভাবে যে, বিষয়টিতে ব্যক্তিবর্গ ও অবস্থাসমূহের বিবেচনায় হুকুমে পরিবর্তন হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি রিয়ার ভয় করবেন অথবা তার দ্বারা কারো (কোন মুসল্লী বা ঘুমন্ত ব্যক্তির) কষ্ট হওয়ার আশংকা করবেন, তার জন্য সিররী জিকির উত্তম। আর যখন এরূপ সমস্যা থাকবে না, তখন জেহেরী জিকির উত্তম হবে। কিতাবুল ফাতাওয়ায় বলা হয়েছে--মসজিদসমূহের মধ্যে জেহেরী জিকির করতে নিষেধ করা যাবে না তা মহান আল্লাহর এ বাণীর আওতাভুক্ত বিষয় হওয়ায় তাত্থেকে বিরত থাকার জন্য--উক্ত বাণী হলো--ومَنْ أظلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مساجدَ اللهِ أنْ يُذكَرَ فيها اسمُه “তার চেয়ে বড় জালিম কে আছে যে মসজিদসমূহে আল্লাহর নামের জিকির করা থেকে বাধা দেয়?” (সূরাহ বাক্বারা, আয়াত নং ১১৪)
(বিস্তারিত দেখুন : হাশিয়াতু ইবনি আবিদীন, ৫ম খণ্ড, ২৬৩ পৃষ্ঠা)
সুতরাং ক্ষেত্রভেদে সিররী জিকির ও জেহেরী জিকিরের যে কোনটাই উত্তম হতে পারে। তাই কোন কারণে কেউ এক পক্ষ নিলে অন্য কারণে অপর পক্ষ নেয়া লোকদেরকে তিনি দোষারোপ করতে পারেন না।
তবে সেররী জিকির করা হোক বা জেহেরী জিকির করা হোক উভয়ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে, তা পালন করতে হবে। তা হলো--সিররী জিকিরে এভাবে উচ্চারণ করতে হবে, যেন নিজের কানে শোনার মতো হয়। তাই তার উচ্চারণে ঠোঁট-জিহবা ইত্যাদি নাড়াতে হবে এবং নামাযের সূরাহ ও দু‘আর মতো স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে হবে। আর জেহেরী জিকিরের জন্য শর্ত হলো--তার কণ্ঠস্বর যেন চিৎকার করে কাউকে ডাকার মতো খুব বেশী উচ্চ না হয়। আর তার আওয়াজে আশপাশের ঘুমন্ত ব্যক্তি বা মুসল্লীদের যেন ব্যাঘাত না ঘটে। সেই সাথে জেহেরী জিকির যেন রিয়া ও সুম‘আ (লোক দেখানো বা মানুষকে শুনিয়ে নিজের আমল প্রকাশ) করার নিয়তে না হয়। সর্বপরি উভয় প্রকার জিকিরের জন্য আবশ্যক হলো--তার উচ্চারণ সহীহ হতে হবে। জিকিরের অন্তর্গত হরফসমূহের বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও মাদ, গুন্নাহ, ক্বলক্বলাহ ইত্যাদি যথাযথভাবে আদায় করা কর্তব্য।
আস্তে জিকির নিয়ে বাধ্যবাধকতা করা বিদ‘আত
খফী জিকির বা আস্তে জিকির নিয়ে বাধ্যবাধকতা করলে তা বিদ‘আত গণ্য হবে। কেননা, মনে মনে বা নিম্নস্বরে জিকির করার নির্দেশ যে আয়াতে রয়েছে, যথা--وَاذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ تَضَرُّعًا وَّخِیۡفَۃً وَّدُوۡنَ الۡجَہۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ “এবং আপনি স্বীয় পালনকর্তার জিকির করুন চুপে চুপে বিনম্রভাবে ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এবং খুব জোরের চেয়ে কম আওয়াজে” (সূরাহ আ‘রাফ, আয়াত নং ২০৫)--এ আয়াতটি মাক্কী, তাফসীরে ইবনে কাসীরের বর্ণনানুযায়ী এ আয়াতের হুকুম ولا تجهر بصلاتك ولا تخافت بها وابتغ بين ذلك سبيلا (সূরাহ ইসরা, আয়াত নং ১১০) আয়াতের হুকুমের অনুরূপ। অর্থাৎ এ আয়াতে বর্ণিত হুকুম তথা মনে মনে বা নিম্নস্বরে জিকিরের বাধ্যবাধকতা ইসলামের প্রথম যমানার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো--যখন জোরে জিকির করলে কাফেররা অত্যাচার করতো। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন কাফেরদের সেই অত্যাচার থাকেনি। তাই মনে মনে বা নিম্নস্বরে জিকিরের বাধ্যবাধকতার হুকুম তখন মানসূখ হয়ে গিয়েছে।
এ ব্যাপারে উপরোক্ত ولا تجهر بصلاتك ولا تخافت بها وابتغ بين ذلك سبيلا আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তাফসীরে ইবনে কাসীরে রয়েছে--
عن ابن عباس قال : نزلت هذه الآية وهو متوار بمكة ( ولا تجهر بصلاتك ولا تخافت بها وابتغ بين ذلك سبيلا ) قال : كان إذا صلى بأصحابه رفع صوته بالقرآن ، فلما سمع ذلك المشركون سبوا القرآن ، وسبوا من أنزله ، ومن جاء به . قال : فقال الله تعالى لنبيه صلى الله عليه وسلم : ( ولا تجهر بصلاتك ) أي : بقراءتك فيسمع المشركون فيسبوا القرآن ) ولا تخافت بها ) عن أصحابك فلا تسمعهم القرآن حتى يأخذوه عنك ) وابتغ بين ذلك سبيلا ) .
أخرجاه في الصحيحين من حديث أبي بشر جعفر بن إياس به ، وكذا روى الضحاك عن ابن عباس ، وزاد : " فلما هاجر إلى المدينة ، سقط ذلك ، يفعل أي ذلك شاء
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-- উক্ত আয়াত “আপনি নামাযে জোরে পড়বেন না এবং আস্তে পড়বেন না, বরং এর মধ্য পথ অবলম্বন করুন” এ আয়াত সে সময় অবতীর্ণ হয় যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় সংগোপনে ছিলেন। সে সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন সাহাবীগণকে নিয়ে নামায পড়তেন, তখন কুরআন পাঠে আওয়াজকে উচ্চ করতেন। তারপর যখন তা মুশরিকরা শুনলো, তারা কুরআনকে গালী দিলো আর কুরআনকে যিনি নাযিল করেছেন এবং যিনি কুরআন নিয়ে এসেছেন, তাঁদেরকে গালী দিলো। তখন আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবী (সা.)কে বললেন, আপনি নামাযে কিরাআতকে উচ্চস্বরে পাঠ করবেন না, যাতে কাফেররা শুনে এবং তারা কুরআনকে গালী দেয়। আর আপনার সাহাবীগণ থেকে আড়াল করে আস্তে পড়বেন না যে, তারা শুনতে না পায়। যাতে তারা তা আপনার থেকে গ্রহণ করতে পারে। আপনি এতদুভয়ের মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করুন। এ রিওয়ায়াতটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রহ.) সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু বিশর জা‘ফর ইবনে ইয়াস (রা.)-এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন। তেমনিভাবে ইমাম জাহহাক (রহ.) এ হাদীসটি রিওয়ায়াত করেছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে। আর সেখানে তিনি এ কথা বর্ধিত করেছেন : “অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হিজরত করেন, তখন এ হুকুম রহিত হয়ে গিয়েছে। এতে যেটা ইচ্ছা আমল করা যাবে।”
(দ্রষ্টব্য :- তাফসীরে ইবনে কাছীর, ২য় খণ্ড, ২৯৭ পৃষ্ঠা ও ৯ম খণ্ড, ৯৩ পৃষ্ঠা)
এ প্রেক্ষিতেই মদীনায় বিভিন্ন সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) জোরে জিকির করেছেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, নামাযের পর রাসূলুল্লাহ (সা) উচ্চস্বরে তাকবীর-তাহলীল ও দু‘আ-জিকির পড়তেন বলে হাদীস শরীফে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে--
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : كُنْتُ أَعْرِفُ انْقِضَاءَ صَلاَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالتَّكْبِيرِ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন--“আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামায শেষ হওয়া বুঝতাম তাঁর (উচ্চস্বরে) তাকবীর শুনে।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮১৯)
তেমনি ফরজ নামাযের পর উচ্চস্বরে জিকির করার বিশেষ আমল সাহাবীগণের মধ্যে বিদ্যমান ছিলো বলে হাদীসে রয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীস নিম্নরূপ--
عن ابْن عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا : أَنَّ رَفْعَ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ حِينَ يَنْصَرِفُ النَّاسُ مِنَ المَكْتُوبَةِ كَانَ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ كُنْتُ أَعْلَمُ إِذَا انْصَرَفُوا بِذَلِكَ إِذَا سَمِعْتُهُ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন--যখন মানুষেরা ফরজ নামায থেকে ফিরেন, তখন জিকিরে আওয়াজকে উচ্চ করা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যমানায় বিদ্যমান ছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “যে সময় মুসল্লীগণ সালাম ফিরাতেন, তখন আমি তাদের উচ্চস্বরে যিকিরের আওয়াজ যখন শুনতাম, তখন তা বুঝতে পারতাম ।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৪১)
তেমনি সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর মধ্যে আইয়্যামে তাশরীকের সময় পথে-ঘাটে ও হাট-বাজারে উচ্চস্বরে জিকির করার নিয়ম ছিলো। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে রয়েছে--
وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ وَأَبُو هُرَيْرَةَ يَخْرُجَانِ إِلَى السُّوقِ فِي أَيَّامِ الْعَشْرِ يُكَبِّرَانِ، وَيُكَبِّرُ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِمَا
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও হযরত আবু হুরাইরা (রা.) যিলহজ্বের দশকে বাজারে যেতেন তাকবীর বলতে বলতে এবং তাদের তাকবীর শুনে মানুষেরা তাকবীর বলতেন।” (হযরত আফফান (রহ.)-এর রিওয়ায়াতে রয়েছে : তাঁরা তখন তাকবীর বলে মানুষদেরকে তাদের সাথে তাকবীর বলানোর জন্যই বাজারে যেতেন।)
(দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, ৪৫৮ পৃষ্ঠা)
অনুুরূপভাবে সাহাবীগণ (রা.) ঘরে, মসজিদে ও বিভিন্ন স্থানে উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে রয়েছে--
وَكَانَ عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يُكَبِّرُ فِي قُبَّتِهِ بِمِنًى فَيَسْمَعُهُ أَهْلُ الْمَسْجِدِ فَيُكَبِّرُونَ وَيُكَبِّرُ أَهْلُ الْأَسْوَاقِ حَتَّى تَرْتَجَّ مِنًى تَكْبِيرًا
“হযরত উমর (রা.) মিনায় স্বীয় হুজরায় তাকবীর বলতেন। সেই তাকবীর মসজিদের মুসল্লীগণ শুনতেন, তখন তাঁরা তাকবীর বলতেন। এবং বাজারের লোকজন (তাঁদের তাকবীর শুনে) তাকবীর বলতেন। তা এ পর্যন্ত হতো যে, মিনা তাকবীর ধ্বনিতে কেঁপে উঠতো।”
(দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা)
তেমনিভাবে স্বাভাবিক পথ চলতে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, উঁচুস্থানে উঠতে “আল্লাহু আকবার” এবং কোন নিচুভূমিতে নামতে “সুবহানাল্লাহ” উচ্চস্বরে পাঠ করা সুন্নাত আমল হিসেবে গণ্য হয়েছে। এ সম্পর্কে সহীহ মুসলিম-এর শরাহ ‘ফাতহুল মুন‘ইম-এর মধ্যে রয়েছে--
كانت السنة رفع الصوت بالتكبير والتهليل كلما علا مرتفعا وكلما هبط واديا
“যতবার কোন উঁচু স্থানে উঠবে এবং যতবার কোন নিম্নভূমিতে নামবে, তখন উচ্চস্বরে তাকবীর ও তাহলীল পাঠ করা সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।
(দ্রষ্টব্য : ফাতহুল মুন‘ইম শরহু মুসলিম, ১০ খণ্ড, ২৫৯ পৃষ্ঠা)
অপরদিকে প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাব মুস্তাদরাকে হাকীম-এর মধ্যে জেহেরী জিকিরের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে فضيلة رفع الصوت بالذكر (উঁচু আওয়াজে জিকির করার ফজীলত) নামে আলাদা শিরোনাম দিয়ে বিশেষ পরিচ্ছেদ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) উচ্চস্বরে জিকিরকারী সাহাবী আবদুল্লাহ যুল বিজাদাইন (রা.)কে “নিবেদিত জিকিরকারী” বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং সেই সাহাবীর ওফাতের পর তাঁর করবে নেমে তাঁর লাশ স্বয়ং নিজ হাতে কবরে রেখে তাঁকে দাফন করেছেন।
(দ্রষ্টব্য : মুস্তাদরাকে হাকিম, ১ম খণ্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ১৩৬১/ অনুরূপ : সুনানে বাইহাকী--শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৫৭৮ প্রভৃতি)
তেমনি অপর রিওয়ায়াতে সন্ধ্যার সময় লোকদের জেহেরী জিকিরকে হযরত উমর (রা.)-এর উৎসাহিত করা সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে--
عن عطية بن قيس قَالَ : كان الناس يذكرون الله عند غروب الشمس، يرفعون أصواتهم بالذكر، فإذا خفضت أصواتهم أرسل إليهم عمر بن الخطاب أن يرددوا الذكر.
“হযরত আতিয়্যা ইবনে কাইস (র.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে মহান আল্লাহর জিকির করতেন। যখন তাদের স্বর নিচু হয়ে গেলো, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খবর পাঠালেন--যেন তারা পুনরায় সেরূপ (উচ্চস্বরে) জিকির করেন।
(দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী, ৫ম খণ্ড, ২৩৭ পৃষ্ঠা/ কিতাবুয জিকর--জা‘ফর আল-ফারইয়াবী, হাদীস নং ৬৯)
তবে খুব বেশী জোরে চিৎকার করে জিকির করলে তাতে জিকিরকারীর কষ্ট হতে পারে বা তার ক্লান্তি চলে আসতে পারে, এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) উচ্চস্বরের জিকিরকে সহনীয়ভাবে করার জন্য বলেছেন। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে রয়েছে--
عَنْ أَبِي مُوسَى رضي الله عنه قَالَ : كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ ، فَكُنَّا إِذَا عَلَوْنَا كَبَّرْنَا (وَفِيْ رِوَايَةِ مُسْلِمِ : فَجَعَلَ النَّاسُ يَجْهَرُونَ بِالتَّكْبِيرِ) ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَيُّهَا النَّاسُ ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ، فَإِنَّكُمْ لاَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا ، وَلَكِنْ تَدْعُونَ سَمِيعًا بَصِيرًا -
হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন--“আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। সে সময় যখন আমরা কোন উঁচু স্থানে উঠতাম, তাকবীর বলতাম। (সহীহ মুসলিমের রিওয়ায়াতে রয়েছে : সে সময় লোকেরা উচ্চস্বরে তাকবীর বলতে থাকেন।) তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন--“হে লোক সকল! তোমরা নিজেদের উপর নম্রতা করো। কেননা, তোমরা কোন বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছো না। বরং তোমরা ডাকছো সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টাকে।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৪৭/ অনুরূপ : সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫০০২)
অবশ্য উক্ত হাদীসে এ নির্দেশনা ওয়াজিব হিসেবে নয়, বরং মুস্তাহাব হিসেবে প্রদান করা হয়েছে বলে মুহাদ্দিসীনগণ বলেছেন। যা বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। তাই এ হাদীস দ্বারা উচ্চস্বরে জিকির করায় নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয় না।
সুতরাং খফী জিকির বা নিঃশব্দে জিকির করা যেমন জায়িয, তেমনি উপরে বর্ণিত দলীলের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হুকুম হিসেবে উচ্চ আওয়াজে জিকির করা বৈধ প্রমাণিত হয়। যার প্রমাণে অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান রয়েছে।
এ জন্য যদি কেউ উচ্চ আওয়াজে জিকির করেন, যদি তিনি এ ব্যাপারে আরোপিত শর্তাবলি পূরণ করেন, যথা-- সেই জিকিরে অন্যের ইবাদতে বা ঘুমে ব্যাঘাত না হওয়া, এতে রিয়া বা লোক দেখানো ভাবের আশংকা না হওয়া ইত্যাদি, তাহলে তাকে বাধা দেয়া কিংবা নিঃশব্দে বা আস্তে জিকির করতে বাধ্য করা বিধেয় হবে না। বরং তাকে জোরে জিকির করতে বাধা দেয়া কিংবা নিঃশব্দে বা আস্তে জিকির করতে বাধ্য করা নাজায়িয ও বিদ‘আত গণ্য হবে।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
দুআ ও পার্থনা
...
কোন নামাযের পর কোন সূরা পড়তে হয়?
ফজরের নামাজের পর: ফজরের পরে নির্দিষ্ট কোনো সূরা পাঠের কথা স্পষ্টভাবে কোনো হাদিসে নেই। তবে হাদিস শরিফ...
প্রতি দিনের কথা ও কাজ সাজিয়ে তুলুন দশটি সহজ জিকির দ্বারা
১- বিসমিল্লাহ: বিসমিল্লাহ শব্দের অর্থ, আল্লাহর নামে শুরু করছি। কাজের শুরুতে (بسم الله) বিসমিল্লাহ বল...